ওসমান হাদী
Sheikh Sadman Al Nafi
শহরটা এখন আর কাঁদছে না।
কাঁদছিল—এই শব্দটা এখন অতীত।
এখন মানুষ বিস্মিত।
এখন মানুষ থমকে আছে।
এখন শহরজুড়ে শুধু একটাই শব্দ—
“ওসমান হাদী…
ওসমান হাদী…
ওসমান হাদী…”
এই শব্দটা রাস্তায়, এই শব্দটা বাসে,
এই শব্দটা চায়ের দোকানে,
এই শব্দটা হাসপাতালের করিডোরে,
এই শব্দটা সবচেয়ে বেশি—ফেসবুকে।
ফেসবুক খুললেই শুধু লেখা—
“ওসমান হাদী আর নেই”
“হাদী ভাই শহীদ”
“হাদীর রক্ত বৃথা যেতে দেব না”
শব্দে শব্দে ভরে গেছে দেশ।
আরিফ আর নীলয় দাঁড়িয়ে ছিল মানুষের ভিড়ের পাশে।
কেউ চিৎকার করছে না, কেউ কাঁদছেও না—
সবাই শুধু একটা নাম বলছে।
নীলয় ফিসফিস করে বলল,
—দেখ… মানুষ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
আরিফ ধীরে বলল,
—কারণ হাদী ভাই শুধু একজন মানুষ ছিলেন না। তিনি একটা ভরসা ছিলেন।
ওসমান হাদী কথা বলতেন সহজ ভাষায়। তিনি বলতেন—প্রতিবাদ মানে ভাঙচুর নয়, প্রতিবাদ মানে মাথা উঁচু করে প্রশ্ন করা।
এই কারণেই মানুষ তাকে ভালোবাসত।
কিন্তু বিস্ময়ের ভেতর দিয়েই ঢুকে পড়ল আগুন।
সন্ধ্যার পর খবর বদলে গেল।
ফেসবুকে পোড়া বাসের ছবি, ভাঙা দোকানের ভিডিও, কালো ধোঁয়ার লাইভ।
একটা শব্দ তখন আর একা রইল না—তার সঙ্গে যোগ হলো আগুন।
নীলয় হতভম্ব হয়ে বলল,
—এই আগুনও কি হাদী ভাই?
আরিফ মাথা নাড়ল।
—না। এটা হাদী ভাইয়ের ভালোবাসাকে পুঁজি করে অন্য কারো খেলা।
তারা এসে দাঁড়াল পোড়া প্রথম আলো অফিসের সামনে।
আরিফের গলা ভারী হয়ে এল।
—হাদী ভাই নিজেই তো বলেছিলেন,
“প্রথম আলো ভাঙলে সত্য থামে না। দরকার হলে আমরা দশটা প্রথম আলো বানাব। ভাঙার রাজনীতি আমার রাজনীতি না।”
এই কথাগুলো এখন আর কেউ শোনে না।
শোনা যায় শুধু শব্দ—
ওসমান হাদী… ওসমান হাদী…
টিভিতে আরেক দৃশ্য।
বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকে ধরা হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রেই বিচার–বিবেচনা ছাড়াই।
নীলয় বিস্মিত হয়ে বলে,
—হাদী ভাই তো এটাও মানতেন না।
আরিফ স্পষ্ট করে বলে,
—তিনি বলেছিলেন,
“যে ভাই কোনো ছাত্র আন্দোলনে কারো ক্ষতি করেনি, গুম করেনি, জুলুম করেনি—সে আওয়ামী লীগের হলেও আমার ভাই। তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
এই কথাটাই ছিল তার রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
আরিফ হঠাৎ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
—আমরা প্রস্তুত। আমরা রাজি। ওসমান হাদীর প্রকৃত খুনিদের ধরতে, প্রমাণ আনতে, আদালত পর্যন্ত যেতে—সবকিছু করতে রাজি আছি।
নীলয় যোগ করে,
—কিন্তু আমরা রাজি নই মাতাল হয়ে আগুন ধরাতে। দেশকে অস্থিতিশীল করে কিছু অর্জন করতে।
আরিফ চারপাশে তাকিয়ে সেই কথাটা বলে—যেটা এখন এই দেশের সবচেয়ে দরকার—
“অপরাধীর কোনো দল–মত হয় না।
অপরাধী মানুষ হিসেবেই অপরাধী।
আমরা কোনো দলকে নয়,
মানুষের অপরাধ চিহ্নিত করে তার শাস্তি নিশ্চিত করব।”
একজন বৃদ্ধ মানুষ কাছে এসে দাঁড়ায়।
তার দোকান পুড়ে গেছে।
সে শুধু বলে,
—আমি ফেসবুকে হাদীর নাম লিখেছি। কিন্তু আমার দোকানটা আর নেই।
এই কথার ভেতর কোনো স্লোগান নেই।
আছে শুধু বাস্তবতা।
রাত নামলে শহরের এক দেয়ালে লেখা দেখা যায়—
“হাদীর নামে আগুন নয়
হাদীর নামে বিচার চাই
ভালোবাসা মানে ভাঙচুর নয়”
ফেসবুকে তখনো শব্দ ঘুরছে—
ওসমান হাদী… ওসমান হাদী…
আরিফ মনে মনে ভাবে—
এই শব্দ যদি আদর্শে বদলায়, তাহলে দেশ বাঁচবে।
এই শব্দ যদি আগুনে বদলায়, তাহলে দেশ পোড়বে।
ওসমান হাদী নেই।
কিন্তু তার নাম এখনো বাতাসে।
প্রশ্ন একটাই—
এই নামটা কি আমরা ন্যায়বিচারের পথে রাখব,
না আগুনের মুখে ঠেলে দেব?
এই উত্তরটাই ঠিক করবে—
ওসমান হাদী শুধুই একটি শব্দ,
না একটি পথ।