#আমার_শহরে_তোমার_আগমন
লেখক: জান্নাতুল_ফেরদৌস_মারিয়া
#অনুগল্প
শহরের আকাশে তখন গভীর মেঘ। বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। জানালার পাশে বসে রিমি বৃষ্টি দেখছিল। টিনের চালে টুপটাপ শব্দ, ভেজা মাটির গন্ধ, আর বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা—সবকিছু মিলিয়ে মনটা আজ ভারী হয়ে ছিল। আজ ঠিক এক বছর পূর্ণ হলো সেই দিনটার, যেদিন আরিয়ান হঠাৎ করেই তার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল।
রিমি এখন কলেজের শেষ বর্ষে পড়ে। শহরের নামকরা একটি ফার্মেসিতে পার্টটাইম কাজ করে। বাইরে থেকে তাকে খুব শক্ত মনে হয়, কিন্তু ভেতরে জমে থাকা ভালোবাসা আর অপেক্ষার গল্প কেউ জানে না।
আরিয়ানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল এক বর্ষার দুপুরে, কলেজ লাইব্রেরিতে। সেদিন ভারী বৃষ্টি হচ্ছিল। রিমির ছাতা ছিল না। লাইব্রেরি থেকে বের হতেই হঠাৎ কেউ একজন ছাতা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
— “ভিজে যাবেন,”
শান্ত, গভীর একটা কণ্ঠ।
চমকে তাকিয়েই রিমির চোখে পড়েছিল সেই অপরিচিত ছেলেটির চোখ। অদ্ভুত শান্ত, অথচ ভেতরে একরাশ লুকোনো গল্প।
সেই প্রথম দেখা। তারপর ধীরে ধীরে পরিচয়, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, আর বন্ধুত্বের আড়ালে নিঃশব্দ ভালোবাসা।
আরিয়ান খুব বেশি কথা বলত না। কিন্তু রিমির প্রতিটি কথায় মন দিয়ে শুনত। রিমি কথা বলতে ভালোবাসত, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত। আরিয়ান ছিল সেই নীরব মানুষ, যে নীরবে কারও স্বপ্নগুলো আগলে রাখে।
দুজনের প্রিয় জায়গা ছিল কলেজের পেছনের পুরনো কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে। বসন্ত এলেই লাল ফুলে ভরে যেত গাছটা। সেখানে বসেই তারা গল্প করত—জীবন, কষ্ট, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
একদিন রিমি হেসে বলেছিল,
— “ভবিষ্যতে আমি একটা ছোট ক্যাফে খুলব, জানো? নাম হবে ‘বর্ষা’।”
আরিয়ান মৃদু হেসে বলেছিল,
— “তাহলে আমি ওই ক্যাফের নিয়মিত কাস্টমার হব।”
কিন্তু সে কখনও বলেনি—
সে কাস্টমারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু হতে চাইত।
ভালোবাসাটা প্রথম বুঝেছিল রিমি নিজেই। একদিন হঠাৎ উপলব্ধি হয়—সে আরিয়ান ছাড়া নিজের দিন কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু আরিয়ান কখনোই নিজের অনুভূতির কথা বলত না।
সবকিছু সুন্দর চলছিল, হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল।
ক্লাস শেষে রিমি তাকে খুঁজছিল। ফোন বন্ধ। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেও নেই। পরদিনও না। এরপরের দিনও না। কয়েকদিন পর খবর পেল—আরিয়ানের পরিবার শহর ছেড়ে চলে গেছে। হঠাৎ, চুপচাপ, কাউকে কিছু না বলেই।
রিমির জীবন যেন থেমে গিয়েছিল।
সে অনেক খুঁজেছে তাকে। বন্ধুবান্ধব, পরিচিত সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কেউ কিছু জানত না। শুধু রয়ে গিয়েছিল অজানা অপেক্ষা, আর বুকের গভীরে চাপা কষ্ট।
এক বছর কেটে গেছে।
আজ সেই বর্ষার দিনটা ফিরে এসেছে। বিকেলে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। জানালার পাশেই বসে ছিল রিমি। হঠাৎ দরজায় একটা কড়া নাড়ার শব্দ।
ক্লান্ত পায়ে দরজা খুলতে গিয়ে সে ভাবছিল—কে আসতে পারে এই বৃষ্টিতে?
দরজা খুলতেই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই চেনা মুখ।
আরিয়ান।
ভেজা চুল, ক্লান্ত চোখ, কিন্তু সেই একই শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
রিমির শরীর অবশ হয়ে এল। বিশ্বাস করতে পারছিল না চোখকে।
— “তুমি…?”
কণ্ঠ বের হলো কাঁপা কাঁপা।
আরিয়ান আস্তে বলল,
— “আমি ফিরে এসেছি, রিমি।”
কথাটা বলেই সে হালকা হাসল। কিন্তু সেই হাসির পেছনে লুকানো ছিল এক বছরের যন্ত্রণার গল্প।
ভেতরে বসে গল্প হলো অনেকক্ষণ।
আরিয়ান জানাল—তার বাবার গুরুতর অসুখ ছিল। হঠাৎ করেই গ্রামে চলে যেতে হয়েছিল। সেই তাড়াহুড়োয় সে রিমিকে জানাতেও পারেনি। পরে অনেক চেষ্টা করেছিল যোগাযোগ করার, কিন্তু রিমির নাম্বার বদলে গিয়েছিল।
— “তোমাকে খুঁজে না পেয়ে আমি ভেবেছিলাম… তুমি হয়তো আমার কথা ভুলেই গেছ,”
নীরবে বলল সে।
রিমির চোখ ভিজে উঠল। সে আরিয়ানাকে বলল,,,,
— “ভুলব কী করে? তুমি তো আমার দিনের অনেকটা জুড়ে ছিলে।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা গেল।
হঠাৎ আরিয়ান গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,,,,,,
— “রিমি… আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আগেও ভালোবাসতাম, কিন্তু সাহস হয়নি বলতে। ভেবেছিলাম হারিয়ে ফেলব। কিন্তু আজ বুঝলাম—না বললে আরও বড় হারানো।”
রিমির চোখ দু’টো যেন এক মুহূর্তে আকাশ হয়ে গেল। এতদিনের অপেক্ষা, বেদনা, না বলা কথা—সব একসাথে ভেসে উঠল।
— “তুমি জানো, আমি কতদিন ধরে এই কথাটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম?”
কাঁপা কণ্ঠে বলল সে।
আরিয়ান তার হাত ধরে বলে,,,,,,
— “আমি আর কোথাও যাব না। যদি তুমি আমাকে থাকতে দাও।”
রিমি মৃদু হেসে বলল,,,,
— “থাকতে দাও কেন? তুমি তো অনেক আগেই আমার হৃদয়ে থাকার অধিকার পেয়েছ।”
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু ঘরের ভেতরটা ভরে গেছে উষ্ণতায়।
সেদিন রাতে তারা আবার সেই পুরনো কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে গিয়েছিল। লাল ফুল তখন নেই, কিন্তু পাখির ডাক, ভেজা পাতার গন্ধ—সবকিছু ঠিক আগের মতো।
আরিয়ান বলে,,,,
— “তোমার ‘বর্ষা’ ক্যাফেটা খুলেছ?”
রিমি হেসে বলল,,,,
— “না… তোমাকে ছাড়া বর্ষা অসম্পূর্ণ ছিল।”
আরিয়ান তার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,
— “তাহলে এবার দু’জন মিলে শুরু করব।”
আকাশে মেঘ, চারপাশে নীরবতা, আর দু’টি হৃদয়—যারা সময় আর দূরত্ব পেরিয়ে আবার একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে।
সেদিন বর্ষার বৃষ্টি শুধু আকাশ ভেজায়নি,
দু’টি হারানো ভালোবাসাকেও আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল।
~সমাপ্ত~