আলোর রেখা
Writer: Robayed Hassan
💖 আলোর রেখা 💖
একবার এক পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল, যার নাম ছিল শান্তিনিবাস। গ্রামটি ছিল সবুজে ঘেরা, কিন্তু এর মানুষের মনে ছিল গভীর বিষাদ। কারণ, গত কয়েক বছর ধরে তাদের প্রধান ফসল ভালো হচ্ছিল না, আর গ্রামের একমাত্র নদীটিও শুকিয়ে আসছিল। হতাশা আর দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছিল সবার জীবন।
এই গ্রামে থাকত এক বৃদ্ধ কাঠমিস্ত্রি, নাম দীনবন্ধু। তাঁর বয়স হয়েছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। গ্রামের সবাই যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ, দীনবন্ধু তখনো প্রতিদিন সকালে উঠে নিজের ছোট্ট কাঠের কারখানায় কাজ করতেন। তিনি সুন্দর আসবাবপত্র বানাতেন—যা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি মজবুত। কিন্তু সবচেয়ে বিশেষ ছিল তাঁর হাতের তৈরি ছোট কাঠের পুতুলগুলি। এই পুতুলগুলির চোখ দেখে মনে হতো যেন তারা কথা বলতে চাইছে।
একদিন, গ্রামের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি রতনলাল তাঁর কাছে এলেন। রতনলাল ছিলেন কঠোর এবং হিসেবি মানুষ। তিনি বললেন, "দীনবন্ধু, আমার মেয়ের বিয়ে। আমি চাই তুমি তাকে উপহার দেওয়ার জন্য এমন কিছু বানাও, যা গ্রামের আর কারও কাছে নেই। দামের কথা ভেবো না, শুধু সেটা যেন সেরা হয়।"
দীনবন্ধু কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তিনি জানতেন রতনলালের আসল চাহিদা 'সেরা' কিছু নয়, বরং এমন কিছু যা তাঁর গর্ব বাড়াবে। কিন্তু দীনবন্ধু অন্য কিছু ভাবছিলেন।
পরের দিন দীনবন্ধু একটি ছোট, কিন্তু অসাধারণ কাঠের বাক্স নিয়ে রতনলালের বাড়িতে গেলেন। বাক্সটি ছিল সাধারণ কাঠের তৈরি, কোনো কারুকার্য ছিল না। রতনলাল বিরক্তির সাথে বললেন, "এ কী দীনবন্ধু? আমি সেরা কিছু চেয়েছিলাম, আর তুমি কিনা এই সাধারণ বাক্স নিয়ে এলে?"
দীনবন্ধু হাসলেন। তিনি বাক্সটির ঢাকনা খুলে দেখালেন। ভেতরে ছিল মাত্র দু'টি জিনিস:
১. একটি হাতে খোদাই করা ছোট্ট চড়ুই পাখি: পাখিটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন এখনই ডানা ঝাপটে উড়ে যাবে। ২. একটি ভাঁজ করা সাদা কাগজ, তাতে দীনবন্ধুর হাতের লেখা:
প্রিয় রতনলাল কন্যা,
যখন তোমার মনে এক আকাশ সমান আনন্দ, তখন এই চড়ুইটিকে দেখো। এটি তোমাকে মনে করিয়ে দেবে যে, আনন্দ কখনওই খাঁচায় বন্দি থাকে না, সে সব সময় স্বাধীনভাবে উড়তে চায়।
আর যখন তোমার মনে অন্ধকার, হতাশায় ভরে যায়, তখন এই সাদা কাগজটিকে দেখো। মনে রাখবে, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গল্পগুলো এখনও লেখা বাকি। তোমার একটি ভালো কাজই সেই সাদা কাগজে এক নতুন আলোর রেখা আঁকতে পারে।
এই বাক্সের আসল দাম এর কাঠ বা খোদাই নয়। এর দাম হলো - তোমার জীবনে নতুন করে আশা জাগানোর ক্ষমতা।
শুভ কামনা, দীনবন্ধু।
রতনলাল প্রথমে খুব রেগে গিয়েছিলেন, কিন্তু যখন তিনি চড়ুইটি আর দীনবন্ধুর লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন, তখন তাঁর চোখ ভিজে এলো। জীবনে প্রথমবারের মতো, তিনি অনুভব করলেন—টাকার চেয়েও বড় কিছু আছে। দীনবন্ধু তাঁর অহংকারকে নয়, বরং তাঁর মানুষের মনকে স্পর্শ করেছিলেন।
রতনলাল তখনই তাঁর কঠোরতা ছেড়ে দিলেন। তিনি দীনবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "তুমি আমার মেয়ের জন্য সেরা উপহার দিয়েছ। তুমি শুধু কাঠমিস্ত্রি নও, তুমি একজন মানুষের মনের কারিগর।"
এরপর রতনলাল গ্রামের মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি নিজের উদ্যোগে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে বাঁধ তৈরি করালেন, আর ফসল ফলানোর জন্য উন্নত বীজ দিলেন। দীনবন্ধুর সেই ছোট কাঠের বাক্সটি শান্তিনিবাস গ্রামের মানুষের মনে আশার আলো ফিরিয়ে এনেছিল।
দীনবন্ধু তাঁর কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, সবচেয়ে বড় উপহার হলো ভালোবাসা, আর সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্প হলো মানুষের মনে আশা জাগানো। মানুষের মন জয় করতে দামি
জিনিসের নয়, আন্তরিকতার প্রয়োজন।