#নীলপরাগের_চিঠি
#মায়াবিনী_মাহরীন
#পর্ব_১
বিন্দু ট্রেনে জানালার পাশে বসেছিল। শীতের শেষ প্রান্তের সকাল, বাইরে কুয়াশার পর্দা ক্রমে পাতলা হয়ে নরম সূর্যের আলো গায়ে পড়ছে। ট্রেনের হুইসেল দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ার মতোই তার ভেতরটাও কেমন শূন্য, অস্থির। গবেষণার কাজে এমন গ্রামে তাকে যেতে হচ্ছে যেখানে ইন্টারনেট তো দূরের কথা, মোবাইল নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করে না। তবু এই প্রজেক্টটা তার ভেতরে অদ্ভুত একটা টান তৈরি করেছে—উত্তরবঙ্গের গহীন একটা গ্রামে শত বছরের পুরনো জমিদারবাড়ির ভগ্নস্মৃতি নিয়ে লোককথার অনুসন্ধান।
ট্রেনটা থামতেই বিন্দু ব্যাগ গুছিয়ে নেমে এল। স্টেশনটা ছোট, দু’পাশে দোকানপাটও নেই বললেই চলে। মাত্র কয়েকজন লোক ঘোরাঘুরি করছে। প্ল্যাটফর্মের সাইনবোর্ডে গ্রামটির নাম লেখা—“রুদ্রপুর”। জায়গাটা নিয়ে নাকি অনেক গল্প আছে, বিশেষ করে একটা বাড়ি নিয়ে। লোকজন একে বলে “চিঠির বাড়ি”—এটাই ছিল বিন্দুর প্রথম আকর্ষণ।
স্টেশন থেকে বেরুতেই সে দেখল, গ্রামের রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে নিস্তব্ধতা। শুকনো পাতার ওপর বাতাস যখন হেলে আসে তখনই একমাত্র শব্দ তৈরি হয়। তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল স্থানীয় গাইড—একজন বছর ত্রিশের পুরুষ, নাম রঞ্জন।
রঞ্জন বলল,
“আপনি বিন্দু ম্যাডাম তো? শহর থেকে আসছেন? এই দিকেই লাগেজ দিন। আজই জমিদারবাড়িটা ঘুরে দেখতে চান?”
বিন্দু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
“হ্যাঁ, যত দ্রুত শুরু করি ততই ভালো। আমাকে ওই বাড়ির ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে।”
রঞ্জনের চোখে একটা অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠল, যেন বাড়িটার নাম শুনলেই অস্বস্তি লাগে। সে নিজের হাতের চাবির গোছাটা বিড়বিড় করে নেড়েচেড়ে বলল,
“আচ্ছা… যাবো। তবে জায়গাটা খুব বেশি সময় থাকার মতো নয়। মানুষ বলে—ওটা খারাপ স্মৃতি ধরে রেখেছে।”
বিন্দু ঠান্ডা গলায় হেসে বলল, “স্মৃতি খারাপ হলে আমি বুঝে নেবো। আমার কাজে সমস্যা হবে না।”
তারা দুজন ধীরে ধীরে গ্রামের সরু পথ ধরে এগোতে লাগল। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি কাঁচা ঘর, ঠেঁকুরে বাঁশে বানানো বেড়া, আর দূরে পাহাড়ের মতো সবুজ গাছপালা। সবকিছু মিলিয়ে জায়গাটা খুব শান্ত, কিন্তু সেই শান্তির গভীরে যেন লুকিয়ে আছে অন্য কোনো অজানা সুর।
পথ হেঁটে প্রায় আধঘণ্টা পর তারা পৌঁছাল পুরনো জমিদারবাড়ির সামনে। বিশাল লোহার গেট ভেঙে নুয়ে পড়েছে। পাঁচিল ভাঙা, ঝোপঝাড়ে ভর্তি আঙিনা। চাতালে শুকনো পাতা জমে আছে বছরের পর বছর। বাড়িটা সামনে দাঁড়িয়েই বোঝা যায়—এটা একসময় মহিমায় ভরা ছিল; এখন সময় তাকে নিঃশব্দে গ্রাস করেছে।
রঞ্জন বলল,
“এই বাড়িটা একসময় রাজবংশের লোকজন ব্যবহার করত। পরে তারা চলে যায়। তারপর থেকে ভুতুড়ে বলে লোকে আসে না।”
“ভুতুড়ে?” বিন্দু চোখ তুলে তাকাল।
রঞ্জন গলায় খুসখুসে হাসি নিয়ে বলল,
“মানুষ তো ভয় পায়। বলে, রাতে নাকি কারো কান্নার শব্দ শোনা যায়। কেউ বলে চিঠির খাম উড়ে বেড়ায় যেদিকে বাতাস নেই। এসব গল্প তো গ্রামে হয়ই।”
বিন্দু দৃঢ়ভাবে বলল, “আমাকে ভুতে ভয় দেখিয়ে কাজ করানো বন্ধ করবেন! দরজা খুলুন।”
রঞ্জন যেন আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বিন্দুর দৃঢ়তার সামনে চুপ করে গেল। সে পুরনো তালাগুলো খুলে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পথ তৈরি করল। দরজা ঠেলে ঢুকতেই একটা ঘন, ধূসর গন্ধ তাদের মুখে এসে লাগল—পুরনো স্যাঁতসেঁতে কাগজ, কাঠ, আর সময়ের নির্দয় ক্ষয়ের গন্ধ।
বাড়ির ভেতরটা বিশাল, কিন্তু সবকিছু ধুলোয় মাখামাখি। ছাদের কাঠে পাখিদের বাসা, দেয়ালে শ্যাওলা, জানালার পাল্লা ভাঙা। যেন কেউ বহু বছর এই বাড়িকে ফেলে রেখেছে।
বিন্দু তার ব্যাগ থেকে নোট, কলম বের করল।
“রঞ্জন, বাড়িটার তলার ঘরগুলো আগে দেখাই ভালো। এখানে একটা পুরনো নথির ঘর ছিল বলে শুনেছি।”
রঞ্জন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। তারা লম্বা বারান্দা পার হয়ে একটা ঘরের সামনে এল। দরজাটা অর্ধেক ঝুলে ছিল। রঞ্জন ঠেলে দরজা খুলতেই গ্রামের বাতাস যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ঘরটা পুরো অন্ধকার—জানালার কাচ ভাঙা, কাঠের ফ্রেমে কিছু জায়গায় ফাটল।
বিন্দু টর্চ জ্বালিয়ে ঘরটা প্রায় সাত-আট মিনিট ধরে দেখল। পুরনো স্টিলের আলমারি, ভাঙা চেয়ারের গাদ, হাড়ির মতো একটা ট্রাঙ্ক ভাঙা টেবিলের পাশে পড়ে আছে। কিন্তু এর কোনো কিছুই বিশেষ নজর কাড়ল না।
আশপাশ দেখে বিন্দুর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সিঁড়ির পেছনের কোণে। সেখানে মাটি খানিকটা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ বা কিছু একটা ওখানে পুঁতে রেখেছিল।
“রঞ্জন, ঐ জায়গাটা একটু খুঁড়বেন?” বিন্দু বলল।
রঞ্জন মাথা চুলকে বলল,
“এরে! এইসব জায়গায় আবার খোঁড়া–খুঁড়ি করলে কি বের হবে কে জানে? সাপ, বিচ্ছু।”
“খুঁড়ুন।” বিন্দুর স্বর এতটাই দৃঢ় ছিল যে রঞ্জন আর তর্ক করল না।
তারা দুজনে কাঠের একটা ভাঙা বাটাম দিয়ে জায়গাটা খুঁড়তে লাগল। কয়েক মিনিট পর লোহার গায়ে আলতো ঠোক্কর লাগার শব্দ এলো।
ধক করে উঠল বিন্দুর বুক।
“এটা তো কোনো লোহার বাক্স মনে হচ্ছে!”
মাটি সরাতেই দেখা গেল একটা ছোট, মরচে ধরা লোহার ট্রাঙ্ক। এতটাই পুরনো যে তালাটা প্রায় ঝুলছে। রঞ্জন কষ্ট করে ধুলো মুছল। তালার ভেতর হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে তালাটা খুলে ফেলল।
বিন্দু হাঁটু গেড়ে বসল।
“আমি খুলছি, ঠিক আছে?”
রঞ্জন মাথা নেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল—তার চোখে ভয়, অস্বস্তি, এবং কৌতূহলের অদ্ভুত মিশ্রণ।
বিন্দু ধীরে ধীরে ঢাকনাটা তুলল।
ঢাকনার ভেতরটা খোলামাত্র, পুরনো কাগজের গন্ধ আর এক ধরনের অদ্ভুত কাঁপুনি তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। ভেতরে রয়েছে—
বহু পুরনো কিছু চিঠি
কিছু খাম
একটা চামড়ার গোটানো নোটবুক
আর একপাশে ভাঁজ করা একটি ফাইল
কাগজগুলো এত পুরনো যে ছুঁলেই ছিড়ে যাবে মনে হয়।
কিন্তু বিন্দুর দৃষ্টি থেমে গেল একটি জিনিসে—
সাদা খামের ভেতর থেকে বের করে রাখা একটি অসমাপ্ত চিঠি।
চিঠিটি অন্য সব চিঠির একেবারে ওপরে রাখা।
খামে কোনো তারিখ নেই।
শুধু বড়, ভারী অক্ষরে লেখা—
“ঈশানী”
বিন্দুর মনে প্রশ্ন জাগল—এই ঈশানী কে? কেন তাকে উদ্দেশ্য করে এত গুরুত্বপূর্ণ করে এমন চিঠি লেখা হয়েছে?
সে চিঠিটা সাবধানে খুলল।
চিঠিতে লেখা—
“ঈশানী,
যদি কখনো আমার কথা সত্যি জানতে চাও—চিঠিটা শেষ পর্যন্ত পড়ো।
তোমাকে যে কিছু কথা বলা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যা আমি কখনো বলতে পারিনি… আজ সেগুলোই লিখছি।
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম, আমি জানতাম না আমার জীবনে এভাবে আলো ঢুকে যাবে।
তুমি জানো না তুমি আমাকে কী শিখিয়েছো, কী বদলে দিয়েছো।
কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ভয়—তুমি হয়তো কখনো আমার সত্যিটা জানতে পারবে না।
আমি জানি, তুমি রাগ করবে, হয়তো ঘৃণাও করবে।
তবুও এই চিঠিটা লেখা দরকার।
আমি… ”
এখানেই চিঠি থেমে গেছে। শেষ কয়েক লাইন ছিঁড়ে গেছে, যেন কেউ ইচ্ছে করে তুলে ফেলেছে। কাগজের নিচের প্রান্তে আঙুল বুলাতে গিয়ে বিন্দুর বুক ভারী হয়ে উঠল।
“এটা অসমাপ্ত চিঠি…” সে ফিসফিস করে বলল।
রঞ্জন দূর থেকে বলল,
“ম্যাডাম, এই চিঠিটা হয়তো ওই ঈশানীর জন্যই লেখা হয়েছিল। কিন্তু ঈশানী এখন কোথায়—কেউ জানে না।”
বিন্দু দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
তার চোখে স্পষ্ট—এটা শুধু কোনো পুরোনো ভালোবাসার চিঠি নয়।
এটার মধ্যে আছে গভীর, ভয়ংকর, লুকোনো সত্য।
চিঠির নিচে ছোট্ট একটা স্বাক্ষর—
“কৌশিক”
এক মুহূর্তে বিন্দুর মন ঝড়ের মতো কেঁপে উঠল।
কৌশিক।
এক অপরিচিত নাম।
এক গোপন চিঠির লেখক।
তার কথায় যেভাবে কান্না, ভয়, অপরাধবোধ, আর ভালোবাসা মিশে আছে—এটা যে সাধারণ কোনো গল্প নয়, তা স্পষ্ট।
বিন্দুর ভেতরে হঠাৎই একটা চুম্বকের মতো টান অনুভব হলো। এই চিঠি তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও—অজানা এক রহস্যের দিকে।
সে বাক্সের বাকি চিঠিগুলো বের করল। সবগুলো একেক সময়ের, একেক ভঙ্গিমার। শুরুতে স্বর নরম, পরে কষ্টে ভারী। কিছু চিঠির খামে ঈশানীর নাম লেখা নেই, শুধু কাগজে লেখা—“তোমার জন্য”।
যার উদ্দেশে এতগুলো চিঠি লেখা, সে কি সত্যিই সেগুলো কখনো পায়নি?
বিন্দুর মনে হলো, হ্যাঁ—যদি পেত, তবে এতগুলো চিঠি একই সঙ্গে বাক্সে জমে থাকত না।
এগুলো কখনোই পাঠানো হয়নি।
হয়তো পাঠানোর সুযোগই হয়নি।
হয়তো পাঠানো নিষিদ্ধ ছিল।
তার মাথা যেন আরও ভারী হয়ে গেল।
এখন রঞ্জন বলল,
“ম্যাডাম, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাড়িটা রাত হলে আরও ভয়ানক লাগে। আর… এমন চিঠি থাকলে ব্যাপারটা ভালো কিছু না।”
বিন্দু একদম দমেনি।
সে ট্রাঙ্কের ভেতরের সমস্ত চিঠি সাবধানে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল।
নোটবুকটাও নিল।
হয়তো সেই নোটবুকেই সবচেয়ে বড় তথ্য লুকিয়ে আছে।
রঞ্জন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
“ওই নামগুলো আর বেশি উচ্চারণ করবেন না। গ্রামের লোক এগুলো শুনতে চায় না। তারা ভাবে আজও তাদের ছায়া এখানে রয়েছে।”
“কেন?” বিন্দু প্রশ্ন করল।
রঞ্জন ধীরে ধীরে বলল,
“কারণ গ্রাম মনে করে—আমরা তাদের প্রতি অন্যায় করেছি। এমন অন্যায় যা ক্ষমা করা যায় না।”
বিন্দু কিছু বলল না।
তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল কৌশিকের অসমাপ্ত চিঠির লাইনগুলো।
“যদি কখনো আমার কথা সত্য জানতে চাও…”
“যাও, শেষ পর্যন্ত পড়ো।”
এই কথাগুলো কি সত্যিই ঈশানীর কাছে পৌঁছেছিল?
নাকি ঈশানী কোনোদিনই জানেনি কৌশিকের শেষ কথা?
আর কৌশিক—সে বেঁচে আছে?
নাকি অনেক আগেই মারা গেছে?
বিন্দু এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। আকাশে সন্ধ্যার নরম আলোর রঙ ছড়িয়ে পড়ছে। হাওয়া বইছে কিন্তু বাড়িটার সামনে এসে বাতাসও যেন ভয় পায়। ঝোপের ভেতর থেকে অদ্ভুত শোঁ শোঁ শব্দ উঠছে।
বিন্দু বাড়ির দিকে শেষবার তাকাল।
তার মনে হলো—ওই দেয়াল, ওই ভাঙা জানালা, ওই ধুলো—সবকিছু যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে—
“সত্য এখানেই লুকানো।”
গাইড রঞ্জন কাঁপা গলায় বলল,
“ম্যাডাম, চলুন। আর দেরি করলে ভালো হবে না।”
বিন্দু ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল।
কিন্তু তার মাথায় সেই অসমাপ্ত চিঠি ঘুরছে—
এক পুরুষ যার নাম কৌশিক।
এক নারী যার নাম ঈশানী।
এক ভগ্নপ্রায় বাড়ি যা মানুষের মুখে ‘চিঠির বাড়ি’ নামে পরিচিত।
একটা বাক্স ভরা না-পৌঁছানো চিঠি।
আর একটি চিঠি—যার শেষ অংশ কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিন্দু মানসিকভাবে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল—
এই রহস্য সে উন্মোচন করবেই।
এই চিঠিগুলো কোনো সাধারণ প্রেমগাথা নয়।
এটা হয়তো এক অসমাপ্ত ইতিহাস।
এক ভুলে যাওয়া মানুষ।
এক দীর্ঘশ্বাস চাপা দেওয়া সত্য।
তার বুকের ভেতর কেমন একটা দৃঢ় শক্তি তৈরি হলো।
এটা যেন শুধু গবেষণা নয়—
কেউ তাকে ডাকছে।
কেউ তাকে তাদের গল্প খুঁজে বের করতে বলছে।
গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিন্দু আকাশের দিকে তাকাল।
কুয়াশা তখন সরে গিয়ে অদ্ভুত নরম আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
তার মনে হলো—
দূরে কোথাও কেউ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে,
হয়তো অপেক্ষা করছে—
যেন কেউ এসে তার বলা না–হওয়া কথা শুনুক।
চলবে.......?