Skip to Content

সন্ধ্যা_রাতের_প্রদীপ

Writer:মায়াবিনী_মাহরীন
December 3, 2025 by
সন্ধ্যা_রাতের_প্রদীপ
Mukto Vabuk
| 1 Comment

সন্ধ্যা_রাতের_প্রদীপ

মায়াবিনী_মাহরীন


বর্ষার কোনো এক বিকেলে—

বৃষ্টি পড়ছে, গ্রামের রাস্তা জলে থইথই করছে।

অদ্রিজা স্কুল থেকে ফিরছিলো। হঠাৎ রাস্তার পাশে কালো গাড়ি থামে। দরজা খুলে বের হয় এক লম্বা, কালো চোখের ঠান্ডা চেহারার পুরুষ —ঈশান


তার পিছনে ৪ জন দেহরক্ষী, সবার চোখ নিচু। কিন্তু ঈশানের চোখ তাকিয়ে আছে অদ্রিজার চোখে।

দুজনের চোখে প্রথম সংঘর্ষ, যেন আগুনের সাথে বৃষ্টির দেখা। অদ্রিজা একটু ভয় পেয়েছিল, কিন্তু নিজের মুখ সরায়নি। ঈশান ধীরে হেঁটে অদ্রিজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে

জিগ্যেস করে— তোমার নাম?

কণ্ঠ ঠান্ডা। নিয়ন্ত্রণ রাজাদের মতো।


অদ্রিজা রেগে বলে— আপনি কে? নাম জিজ্ঞেস করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?


ঈশান হেসে বলে— আমাকে কেউ অধিকার দেয় না, আমি নিজেই বানাই।

ঈশান চলে যায়। অদ্রিজার মনে থাকে ভয় আর কৌতূহল।

———


মৌলভীবাজার জেলার শান্ত, সবুজে ঘেরা গ্রামে থাকে অদ্রিজা। নরম স্বভাবের, দুর্দান্ত সাহসী এক মেয়ে।

লোকজন বলে—তার হাসি নাকি রোদে বৃষ্টির গন্ধ আনে। সে অনাথ। সে নিজের মতো করে স্কুলে পড়ায়, ঘর চালায়, গাছপালার সাথে কথা বলে।

———


হিমালয়ের শেষে পাহাড়ঘেঁষা, উত্তর বাংলার নিষিদ্ধ এক জনপদ—অগ্নিখাল। লোকে বলে, ওখানে মানুষের নয় আগুনের আত্মারা বাস করে। তাদের রক্ষা করে —ঈশান বংশ। ঈশানের বাবা দুনিয়ার ভয়ংকর ক্ষমতাধর মানুষ। তার মৃত্যুর পর পুরো অগ্নিখালের নিয়ন্ত্রণ আসে ঈশানের হাতে— একটা রুক্ষ, নীরব, অসীম ক্ষমতার সম্রাট।


সেদিন রাতে ঈশান তার দূর্গের দেহলিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুক্ষন পর সে তার বলাধ্যক্ষ দেবাংশকে ডেকে বললো অদ্রিজাকে আমার চাই। দেবাংশ কিছু বলতে গেলে ঈশান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে— 

আমি যা চাই তা পেয়েই ছাড়ি। সেটা সেচ্ছায় হোক বা ছিনিয়ে।

এই বলেই ঈশান চলে গেলো। 


পরদিন সকালে ----

রাস্তার ২ পাশে ১০টা গার্ড, ২টা কালো গাড়ি আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশান। অদ্রিজা স্কুলে যাওয়ার পথে থেমে যায়। ঈশান সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে —

আজকে তোমাকে নিতে এসেছি।


অদ্রিজা বলে উঠে— আমি কোথাও যাচ্ছি না। আর আপনি কে?


ঈশান কোন আবেগ ছাড়াই বলে—

তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী।


অদ্রিজার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো।

আপনি কি পাগল? আপনাকে বিয়ে করব কেন?”


ঈশান শুধু বললো—

কারণ আমার নিয়তি তোমায় ডাকছে।

কথা শেষ করেই অদ্রিজাকে টেনে গাড়িতে তুললো।


অদ্রিজা চোখে আগুন নিয়ে বলে—আমি আপনাকে কখনো মেনে নেব না। সারাজীবন ঘৃণা করব।


ঈশান হালকা হেসে বলে— সময় বদলায়, তুমিও বদলাবে। 


অদ্রিজাকে নিয়ে যাওয়া হয় অগ্নিখালে—

চারদিকে আগুনের চিহ্ন, কালো দেয়াল, অস্ত্র, পাহারাদার।

এসব দেখে অদ্রিজার চোখে ভয় জমে।


ঈশান শান্ত গলায় অদ্রিজাকে বলে—

ভয় নেই, এখানে কেউ তোমায় কিছু করবে না কারন তুমি আমার।


আমার শব্দটা অদ্রিজার মনে ছুরি হয়ে বিঁধে।


প্রথম কয়েকদিন অদ্রিজা কথা বলে না। খায় না। শুধু কাঁদে। ঈশান দূর থেকে সব দেখে কিন্তু কাছে যায় না। কারণ তার আগুন যদি অদ্রিজাকে স্পর্শ করে অদ্রিজা ভস্ম হয়ে যাবে।


হঠাৎ অদ্রিজা জ্বরে পড়ে। ঘুমের মধ্যে বকছে—

আমাকে বাড়ি নিয়ে যান।


ঈশান নিজে ডাক্তার ডেকে আনে। রাতভর তার খেয়াল রাখে। দেবাংশ দেখে বলে—

আপনাকে এভাবে কখনো দেখিনি !


ঈশান নরম গলায় উত্তর দেয়,

ও আগুন নয় ও বৃষ্টি, যা আমার আগুনকে নেভাতে পারে।   


অদ্রিজা আধো ঘুমে চোখ খুলে দেখে—ঈশান তার হাত ধরে বসে আছে। তার চোখে আগুন নেই, আছে অদ্ভুত কোমলতা। এক মুহূর্তের জন্য অদ্রিজার ভয়টা কমে যায়। কিন্তু পরে ঘৃণা আবার ফিরে আসে।


এরমধ্যে অগ্নিখালের পুরনো শত্রু—যারা ঈশানের বাবাকে মেরেছিল তাদের নেতা রুদ্র অদ্রিজাকে দূরে সরিয়ে ঈশানকে দুর্বল করার ছক আঁকে। তারা গোপনে অদ্রিজার কাছে পত্র পাঠিয়ে জানায়, আসলে ঈশান তাকে র/ক্ষি/তা হিসেবে এখানে রাখতে চায়।


এই খবর ঈশানের কানে যায়। তার চোখ দুটো আগুনের মতো লাল হয়ে ওঠে। দেবাংশ ঈশানকে বলে—সামলে নিন। যদি আগুন ছাড়েন, অগ্নিখাল জ্বলে যাবে। 


ঈশান কথা শোনে না। বৃষ্টি, ঝড়, অন্ধকার কিছুই তাকে থামাতে পারে না। রুদ্রের আস্তানায় পৌঁছে

সে রুদ্রর ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে সিংহের ন্যায় ফিরে আসে।


অদ্রিজা তখন বুঝল—

এই মানুষটা যতই ভয়ংকর হোক, তার ভেতরটা শুধু ভালোবাসা আর একাকিত্বে ভর্তি। আর তার প্রতি ঈশানের ভালোবাসাটা মিথ্যা না।


দিন যায় ঈশান অদ্রিজাকে স্পর্শ করে না। শুধু দূর থেকে দেখে। অদ্রিজার ঘৃণা নরম হতে শুরু করে।


এরপর একদন অদ্রিজা প্রথমবার নিজের ইচ্ছায় ঈশানের হাত ধরে। ঈশান অবাক হয়ে অদ্রিজার দিকে তাকালে সে বলে—


আপনার শক্তিশালী ভালোবাসার কাছে আমার ঘৃণা হেরে গেছে। অদ্রিজা তার হাত ধরে— সেই হাত, যেটা শক্ত, রুক্ষ, যুদ্ধের গন্ধে ভরা— তাকে নিজের বুকে ঠেকিয়ে অদ্রিজা বলে—

এই হাতই আমার জন্য আগুনে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। এই হাতই আমার মাথার জ্বর নামিয়েছে। এই হাতই আমাকে বাঁচিয়েছে। এই হাতই প্রথমবার আমাকে নিজের চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আপনি আমার নিরাপত্তা,আমার নিয়তি। আমি আপনাকে বেছে নিয়েছি। আপনার বুকে মাথা রেখে যদি আমার মৃত্যুও আসে তা আমি ভালোবেসে গ্রহন করবো।


অদ্রিজার কথায় ঈশানের সমস্ত শক্তি ভেঙে যায়। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে। হাওয়ায় আগুনের গন্ধ মিশে গিয়ে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।


ঈশান বলে উঠে—

অদ্রিজা, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও, আমি বাঁচব।

কিন্তু তুমি যদি আমাকে নিজের বলে ডাকো আমি সেই আগুন হয়ে উঠবো, যা তোমাকে রক্ষা করতে আকাশ পর্যন্ত পোড়াতে পারে।


অদ্রিজা ঈশানের চোয়ালে হাত রেখে বলে—

তাহলে পোড়ান, আমি আপনার বৃষ্টি হয়ে থাকবো।

আর যদি দরকার হয়, আপনার সাথে জ্বলে যাবো। তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে অন্তিম প্রার্থনা করি এটাই যেন আপনার বুকে মাথা রেখে আমার মৃত্যুটা হয়।


ঈশানের চোখ ভিজে ওঠে। সে ধীরে অদ্রিজার হাত চেপে ধরে বলে—

তুমি আমার অন্ধকার জীবনে উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বললে। তুমি আমার 'সন্ধ্যা রাতের প্রদীপ' ।


সেই রাতেই অগ্নিখালে সবচেয়ে বড় উৎসব হয়। আগুন আর ফুলের মাঝে দুইজনের বিয়ে হয়। আগুনে ঘেরা উঠোনে অদ্রিজা লাল শাড়িতে দাঁড়ায়।


ঈশান প্রথমবার তার হাত ধরে থেমে যায়—

কষ্ট দিয়েছি তোমায়।


অদ্রিজা উত্তর দেয়—

আপনি আমাকে নিয়তি দিয়ে এনেছিলেন। ভালোবাসা আমি দিয়েছি। 

পুরো সাম্রাজ্য আনন্দে ভরে উঠে যেন যুগের পর যুগ সবাই এই দিনেরই অপেক্ষায় ছিলো। 


এরপর অদ্রিজা ঈশানকে এমনভাবে ভালোবাসতে শুরু করে, যেন আগুনের পাশে দাঁড়িয়েও বৃষ্টি নামানো যায়।

ঈশানও তাকে এমনভাবে রক্ষা করে, যেন পৃথিবী যদি আগুন হয়ে যায় কিন্তু সে অদ্রিজাকে ছুঁতে দেবে না।

ঘৃণা ভেঙে ভালোবাসা জন্ম নেয়। যার জন্ম দেয় নিয়তির।

আর নিয়তি গড়ে দিল শেষ সত্য—

"আগুনের রাজাও বৃষ্টি ছাড়া বাঁচে না।"


কিন্তু এই আনন্দ সহ্য করতে পারে না রুদ্রর ছোট ভাই রনবীর। সে ছক আঁকতে থাকে কিভাবে ঈশান বংশকে শেষ করে দিতে পারবে। বহু দিনের প্রতিক্ষার পর সেই সুযোগ পেয়েও যায়।


সেদিন ছিলো অদ্রিজার সাধ এর অনুষ্ঠান। ঈশান বংশের প্রদীপের অপেক্ষায় গোটা অগ্নিখাল। অতিথিদের ভীরে ঢুকে পড়ে রনবীরের লোকজন। জ্বালিয়ে দেয় পুরো নগরী। ঈশানসহ ঈশানের সব সেনারা শেষ করে দেয় রনবীর সহ তাদের দলের সকলকে কিন্তু ততক্ষনে অদ্রিজার পেটে কেউ ধারালো তলোয়ার চালিয়ে দেয়। ঈশান ছুটে আসে অদ্রিজার কাছে। ঈশানের হাত কাঁপছিল, তার আগুন নিভে যাচ্ছিল অদ্রিজার নিস্তেজ স্পর্শে। ঈশান বলে উঠে—

তুমি কথা বলো না। কিছুই হবে না, কিছুই না।

ঈশানের কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছিল।


অদ্রিজা ধীরে হেসে বললো—

আগুন কি কোনোদিন বৃষ্টিকে ধরে রাখতে পারে?


তার চোখ ধীরে বন্ধ হয়ে আসছিল। ঈশান তাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলল—

না, তুমি আমার নিয়তির লেখা। মৃত্যু তোমাকে ছুঁতে পারে না। আমি তাকে পুড়িয়ে ফেলব।শুনছো? পুড়িয়ে ফেলব!


অদ্রিজার ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি—

সব আগুন সব রাজত্ব সব শক্তি একদিন থেমে যায়। কিন্তু ভালোবাসা থামে না। আপনি বাঁচবেন আমার জন্য বাঁচবেন।


ঈশান তার কপালে চুমু রাখতেই অদ্রিজার নিঃশ্বাস থেমে গেল। ঈশান বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয় অদ্রিজাকে। অদ্রিজার প্রাণভোমরা যেন এই বুকের সন্ধানেই স্থির ছিলো এতক্ষন। ঈশানের বুকে লেপ্টে থাকে অদ্রিজার নিথর দেহ। অদ্রিজার অতীতের প্রার্থনা যেন ধ্রুব সত্যতে রূপ নেয়।


সেই মুহূর্তে অগ্নিখালের সব আগুন নিভে গেল। দশ পাহাড় দূর পর্যন্ত নেমে এল অন্ধকার। যেন পুরো সাম্রাজ্য বুঝে গেল—

তার রাণী নেই।


ঈশান অদ্রিজাকে বুকে নিয়েই বসে রইল। হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হলো। এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি তার গালে পড়তেই সে ফিসফিস করে বলল—

তুমি আমার আগুন নিভিয়ে দিয়ে গেলে কিন্তু নিজের আলোটা রেখে গেলে। আমি বেঁচে থাকব সেই আলো জ্বালিয়ে।


অগ্নিখালের রাজা সেই রাতে প্রথমবার কাঁদল। আর সেই কান্নায় পাহাড়ের আগুন আবার জ্বলে উঠল যেন অদ্রিজা ফিসফিস করে বলছে—


"আমি কোথাও যাইনি। আমি তোমার সন্ধ্যার প্রদীপ হয়ে আছি। তোমার অন্ধকারে, তোমার আগুনে —চিরকাল।"


সমাপ্ত

Sign in to leave a comment